ঢাকা,রোববার, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪

অপরাধ, রাজনৈতিক উত্থান ও অনৈতিক সুবিধা নিতে অপব্যবহার বেড়েছে

‘সাংবাদিক’ নাম ভাঙিয়ে অপকর্ম, বিব্রত পেশাদার সাংবাদিকরা

নিউজ ডেস্ক :: করোনাভাইরাস পরীক্ষা নিয়ে প্রতারণার কারণে রিজেন্ট হাসপাতালের মালিক মো. সাহেদ পুলিশের হাতে ধরা পড়ার পর জানা গেল তিনি একটি সংবাদপত্রের সম্পাদক ও প্রকাশক। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা থেকে শিশু অপহরণের দায়ে লুপা তালুকদার নামের এক নারী ধরা পড়ার পর জানা গেল তিনিও সাংবাদিক; একটি টেলিভিশনের ক্রাইম রিপোর্টার, নিজেও একটি অনলাইন টিভির মালিক।

এ ছাড়া ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) সম্প্রতি অভিযান চালিয়ে রাজধানী থেকে আটক করে কয়েকজন প্রতারককে। যারা অনলাইন সংবাদপত্র ও টেলিভিশন খুলে বিভিন্নজনকে নিয়োগ দিয়েছে, যারা বিভিন্ন ব্যক্তিকে ‘নিউজ করে দেব’—এমন ভয়-ভীতি দেখিয়ে টাকা নিয়ে আসে।

যশোরে কলেজছাত্রীকে ধর্ষণের দায়ে এক যুবক ধরা পড়ার পর জানা গেল সেও সাংবাদিক, ছাত্রীকে টেলিভিশনের লাইভ অনুষ্ঠানে অংশ নেওয়ার কথা বলে এনে ওই অপকর্ম করেছে।

এভাবে ‘সাংবাদিক’ পরিচয় দিয়ে অপরাধ সংঘটনের প্রবণতা সম্প্রতি সারা দেশেই বেড়ে গেছে। এতে সাংবাদিকতার মতো একটি পেশার মর্যাদা হুমকির মুখে পড়েছে। বিব্রতকর পরিস্থিতির মুখোমুখি হচ্ছেন প্রকৃত ও পেশাদার সাংবাদিকরা।

সাংবাদিকতার নাম ব্যবহার করে যারা প্রতারণা করছে তাদের চিহ্নিত করে কঠোর শাস্তির আওতায় আনার তাগিদ দিয়েছেন গণমাধ্যম বিশেষজ্ঞরা। এ জন্য গণমাধ্যম ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণেরও তাগিদ দিয়েছেন তাঁরা।

সমাজে ‘সাংবাদিক’-এর গ্রহণযোগ্যতা বা বিভিন্ন স্থানে সহজ প্রবেশাধিকারের কারণে এর অপব্যবহারের প্রবণতা দীর্ঘদিন থেকেই চলে আসছে। রাজনৈতিক প্রভাব বৃদ্ধি, অনৈতিক সুযোগ-সুবিধা আদায়, অপরাধ ঢাকা দেওয়া ও অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড পরিচালনার জন্য ‘সাংবাদিক’ পরিচয় ব্যবহার করে অনেক অসৎ লোক, অনেক অপরাধী। অনেকে প্রশাসনে ও প্রভাবশালী ব্যক্তিদের নৈকট্য লাভের জন্যও সংবাদমাধ্যমকে ব্যবহার করে। তথ্য-প্রযুক্তির সহজলভ্যতার সুযোগে যেকোনো একজন ঘরে বসেই একটি সংবাদমাধ্যম খুলে বসার সুযোগ পাচ্ছে। কোনো খরচ ছাড়াই সামান্য প্রযুক্তিজ্ঞান নিয়ে ফেসবুক টিভি কিংবা ইউটিউব চ্যানেল চালু করা যাচ্ছে। অল্প খরচেই একটি অনলাইন নিউজ পোর্টাল চালু করে ফেলতে পারছে। অপরাধী ও ধান্দাবাজরা এই সুযোগ গ্রহণ করছে। দাগি অপরাধীরাও ‘সাংবাদিক’ নাম ভাঙিয়ে প্রতারণা করছে। নানা অপকর্ম করে পার পেয়ে যাচ্ছে।

ঢাকা থেকে প্রকাশিত কিছু ভুঁইফোড় সংবাদপত্র সারা দেশে প্রতিনিধি নিয়োগ করার নামে কার্ড বিক্রি করে এই অপতৎপরতার সুযোগ তৈরি করে দিচ্ছিল আগে থেকেই। কিছু বেসরকারি টেলিভিশনও অর্থের বিনিময়ে সারা দেশে প্রতিনিধি নিয়োগ দিচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে। আর এখন তো চাইলেই যে কেউ অললাইন মিডিয়ার ‘মালিক’, ‘সম্পাদক’, ‘সাংবাদিক’, ‘রিপোর্টার’ হতে পারছে।

যশোরের একটি অনলাইন পোর্টালের রিপোর্টে বলা হয়েছে, ‘এক হাজার থেকে পাঁচ হাজার টাকায় সাংবাদিক কার্ড কিনে যশোর জেলা চষে বেড়াচ্ছে শতাধিক ভুয়া সাংবাদিক। অসাধুচক্রের কাছ থেকে অখ্যাত পত্রিকা, অনলাইন পত্রিকা ও অনলাইন টিভির কার্ড নিয়ে যথেচ্ছাচার করে বেড়াচ্ছে এসব ব্যক্তি। তারা সাংবাদিক সেজে মোটরসাইকেলে ‘প্রেস’ ও ‘সাংবাদিক’ লিখে বোকা বানাচ্ছে বিভিন্ন মহলকে। অনেকে রীতিমতো মাদক বহনের কাজও করছে।’

এক ধরনের অনলাইন পোর্টাল দীর্ঘদিন ধরে অপসাংবাদিকতার কাজেই ব্যবহৃত হচ্ছে। বিভিন্নজনের ব্যক্তিগত বিষয় প্রকাশ করে দেওয়া হবে বলে হুমকি দিয়ে অনৈতিক তৎপরতা চালাচ্ছে। এদের বিরুদ্ধে তথ্য বিকৃতি, গুজব ছড়ানোরও অভিযোগ রয়েছে। বেশির ভাগ নিউজ পোর্টালের বিরুদ্ধে সাংবাদিকতার রীতিনীতি না মেনে সংবাদ প্রকাশের অভিযোগ রয়েছে।

অনলাইন পোর্টালগুলোর অনুমোদন দেওয়ার ক্ষেত্রে সতর্কতা অবলম্বন, এগুলোর অপব্যবহার হচ্ছে কি না তা পর্যবেক্ষণ করা উচিত বলে অনেকেই মনে করেন। অনলাইন নিউজ পোর্টাল নিবন্ধনের জন্য সরকারের উদ্যোগকে তাই অনেকেই স্বাগত জানিয়েছেন।

বিশিষ্ট লেখক স্থপতি শাকুর মজিদ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে লিখেছেন, ‘আমরা অবাধ তথ্যপ্রবাহ চাই। কিন্তু তথ্যপ্রবাহের মাধ্যমটি কার হাতে যাচ্ছে, সেটি যথাযথ ব্যবহারের যোগ্যতা তার আছে কি না, মাধ্যমটি ব্যবহারের উদ্দেশ্য কী—এসব বিষয় যাচাই করা উচিত।’

‘প্রেসক্লাব’, ‘মানবাধিকার সাংবাদিক’, ‘পরিবেশ সাংবাদিক’ প্রভৃতি নামে প্রতারণা চলছে সারা দেশে। মানবাধিকার সংগঠনের নামে প্রতারণার অভিযোগে এর আগে ভুয়া সাংবাদিক ও তথাকথিত মানবাধিকার সংগঠন ‘ইন্টারন্যাশনাল হিউম্যান রাইটস ক্রাইম রিপোর্টার্স ফাউন্ডেশন’-এর চেয়ারম্যান এস এম হুমায়ুন কবীরসহ তিনজনকে আটক করেছিল পুলিশ। পরে জানা যায়, এই সংগঠনটি ঢাকাসহ সারা দেশে টাকার বিনিময়ে প্রায় ১৫ হাজার ব্যক্তিকে ‘প্রেস’ লেখা আইডি কার্ড বিতরণ করেছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষক ও সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক মনে করেন, এ দেশে প্রতারণা করে সহজে পার পাওয়া যায়, এ কারণে সাংবাদিকতার নামেও প্রতারণা বেড়ে যাচ্ছে। কালের কণ্ঠকে তিনি বলেন, ‘সাংবাদিক’ নামধারী অপরাধীদের চিহ্নিত করে কঠোর শাস্তির মাধ্যমে দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারলেই এই প্রতারণা রোধ করা সম্ভব। এ জন্য গণমাধ্যম ও নিরাপত্তা বাহিনীর সমন্বিত উদ্যোগ জরুরি।

অধ্যাপক আরেফিন সিদ্দিক মনে করেন, তথ্য-প্রযুক্তির অবাধ ব্যবহারের সুযোগকে যারা অপব্যবহার করছে, প্রতারণামূলক কাজে সাংবাদিকতাকে ব্যবহার করছে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত। এদের বিরুদ্ধেই ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন প্রয়োগ করা উচিত বলেও তিনি অভিমত ব্যক্ত করেন।

বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের সহসভাপতি সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা মনে করেন, রাজনৈতিক ও ব্যাবসায়িক ফায়দা লোটার প্রবণতা থেকেই সাংবাদিকতার নাম ব্যবহারের প্রবণতা বেড়ে গেছে। গণমাধ্যমের প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতার সুযোগ নিচ্ছে তারা। প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতার কারণেই লোপা তালুকদারের মতো প্রতারক, যে খুনের মামলারও আসামি, সে কোনো প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ পেয়ে যাচ্ছে, সে সাংবাদিক ইউনিয়নেরও সদস্য হয়ে যাচ্ছে। নিয়োগ দেওয়ার ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানগুলোকে আরো ভাবতে হবে।

পাঠকের মতামত: